ঢাকা    সোমবার, ২০ মে ২০২৪


প্রচ্ছদ » অন্যান্য » কুয়াকাটা উপকূলে পাখিদের কলরবে মুখর

কুয়াকাটা উপকূলে পাখিদের কলরবে মুখর


আঃ মজিদ খান, (পটুয়াখালী )
প্রকাশ: শনিবার, ৪ নভেম্বর ২০২৩


 কুয়াকাটা উপকূলে পাখিদের কলরবে মুখর
পটুয়াখালী: নির্বিরোধী পাখি চড়ুই। কারও সাতে-পাছে নেই। গৃহস্থ ঘরের টিনের চালের কোণায় এবং পাকা ভবনের কার্নিশে খড়খুটোয় তার বাস। গাছের ডালেও বাসা বাঁধে। কিচিরমিচির শব্দ তুলে লোকজনকে ভোররাতে ঘুম থেকে ডেকে তোলাই যেন কাজ। দিনের যখন তখন যত্রতত্র এটির দেখা মেলে। দল বেঁধে খাবার খুঁজে বেড়ায়। ইদানীং নিরীহ প্রজাতির এ পাখির দেখা তেমন মিলছে না। ক্রমে কমে যাচ্ছে চড়ুইয়ের সংখ্যা। শুধু চড়ুই নয়। এমন অনেক চিরচেনা প্রজাতির পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে উপকূলীয় এলাকা থেকে। ইতোমধ্যে বহু প্রজাতির পাখি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার অনেক প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির দিন গুনছে। এরমধ্যে অনেক প্রজাতির পাখি এখন একেবারেই কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
উপকূল মানেই সাগর তীরবর্তী অঞ্চল, বিস্তীর্ণ তটরেখা আর ঘন অরণ্য। ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছের সবুজের সমারোহ। আর এ গাছপালা ঘিরে একটা সময়ে দেখা যেত শত শত প্রজাতির পাখি। মাত্র চার-পাঁচ দশক আগেও উপকূলীয় অঞ্চল ছিল পাখিদের অভয়ারণ্য। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতায় জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে এ অঞ্চলের চিরচেনা অনেক দৃশ্য। আরও অনেক বিষয়ের সঙ্গে পাখিদের জগতেও নেমে এসেছে বিপর্যয়। অবশ্য অবাধ পাখি নিধনও এর জন্য কম দায়ী নয়। এক শ্রেণির শিকারি গত কয়েক দশক ধরে নির্বিচারে পাখি নিধন করে আসছে। সে সঙ্গে যোগ হয়েছে বন উজাড়। বেপরোয়া বন উজাড়ে পাখির স্বাভাবিক পরিবেশে ঘটেছে ব্যাপক ব্যত্যয়। এছাড়া, খেত-খামারে সার-কীটনাশকের ছড়াছড়িতেও প্রতিনিয়ত মারা পড়ছে অসংখ্য পাখি। এসব কারণের অনিবার্য পরিণতিতে পাখপাখালির জগতেও লেগেছে হাহাকার।
তিন-চার দশক আগেও পটুয়াখালী-বরিশাল অঞ্চলে গাছের ডালে বসে লেজ দোলানো ‘হলদেপাখির’ ছড়াছড়ি ছিল। হলদে পাখি নিয়ে মরমি গায়ক আবদুল আলীম দরাজ কণ্ঠে গেয়েছিলেন, ‘হলুদিয়া পাখি, সোনালী বরণ, পাখিটি ছাড়িল কে-রে’। হলদে পাখির সংখ্যা যেভাবে কমে আসছে, তাতে একদিন হয়তো পাখির নামটি টিকে থাকবে শুধু গান কবিতা ছড়ায়। হলদে পাখি স্থানীয়ভাবে ‘বেনেবউ’ বা ‘ইষ্টিকুটুম’ নামেও পরিচিত। লালচোখের এ পাখির গায়ের রঙ গাঢ় হলুদ। মাথা, লেজ, ডানা ও গলার অংশের কিছু পালক কালো বর্ণের। ছেলে ও মেয়ে পাখি দেখতে প্রায় একই রকম। তবে মেয়ে পাখির মাথার কালো রং কিছুটা ফ্যাকাসে। গাছের ডালে ডালে মোকা মাকড় আর ফল খেয়ে বেঁচে থাকা হলদে পাখির স্বর অনেকটাই কর্কশ। সুদৃশ্য এ প্রজাতির পাখির ইদানীং দেখা প্রায় মিলছে না।
উপকূলীয় অঞ্চলে এক সময়ে পায়রা জাতের কয়েক প্রজাতির ঘুঘু দেখা যেত। এক শ্রেণির দক্ষ শিকারি মাঠেঘাটে ঝোপ জঙ্গলে ফাঁদ পেতে ঘুঘু শিকার করত। খাঁচার মতো দেখতে ছিল সে ফাঁদ। বহু মানুষ শখ করে ঘুঘু পুষতো। কিন্তু এখন ঘুঘুর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। একইভাবে কমে গেছে গেরস্ত বাড়ির লোকজনের শখ করে পোষা আরেক প্রজাতির পাখি টিয়া। খাঁচায় পুরে আদর সোহাগ করে দুধ কলা খাওয়ানোর দৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। টিয়াকে দিয়ে কথা বলানোর কসরতও ছিল দেখার মতো। টিয়া প্রধানত নারকেল গাছের কোটরে বাসা বাঁধতো। মাঝেমধ্যে গাছের কোটরে হানা দিত বিষাক্ত সাঁপ। কিন্তু এখন বিষাক্ত সাঁপের সংখ্যা যেমন কমে গেছে। তেমনি কমে গেছে হরেক প্রজাতির টিয়া।
প্রায় বিলুপ্তির তালিকায় চলে গেছে কুকুয়া নামের পাখিও। এটি অনেকের কাছে ‘কানাকোকা’ নামে অধিক পরিচিত। দেখতে অনেকটা কাকের মতো। তাই এর নাম কানাকোকা। তবে কাকের চেয়ে আকারে বেশ কিছুটা বড়। কেউ কেউ ‘কুক্কা’ নামেও ডাকেন। এর চোখের মণি বাদামি। উজ্জ্বল আলোয় চোখ ঝলসে ওঠে। ডানা দুটিও একই রঙের। বাকি শরীর কুচকুচে কালো এবং খয়েরি। সাপ ব্যাঙ এবং কীটপতঙ্গ খেয়ে জীবনধারণ করা কুকুয়াকে ‘পরিবেশবান্ধব’ পাখি হিসেবেও অনেকে বিবেচনা করেন। চিল এবং শকুন দুটোই উপকূলীয় এলাকা থেকে বহু আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সত্তরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে উপকূলীয় অঞ্চলে শকুনের দেখা প্রায় মেলেনি। অনেকটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে শকুন। এমনকি ঘূর্ণিঝড় সিডর আইলার পরেও এ অঞ্চলে শকুন দেখা যায়নি।দেখা মেলেনি গভীর আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখি চিলেরও।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ঈগল এবং বাজপাখিরও তেমন দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। খুব কম দেখা মিলছে নিশাচর বাঁদর এবং পেঁচার। মাত্র কয়েক বছর আগেও এ অঞ্চলের বাগানে বাগানে অজস্র বাঁদরের দেখা মিলতো। সারারাত ঘুরে বেরিয়ে আর দিনের বেলা উঁচু গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে সময় কাটানো পাখি বাঁদরের দেখা এখন কদাচিৎ মিলছে। পেঁচার অন্তত চার-পাঁচটি প্রজাতির দেখা পাওয়া যেত সর্বত্র। কিন্তু এখন মাঝেমধ্যে এক দুটি পেঁচার দেখা মিললেও তার সে রূপ আর নেই। কেমন যেন চুপসে যাওয়া এক প্রাণীতে পরিণত হয়েছে পেঁচা।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি পাতিকাক এবং দাড়কাকের সংখ্যাও উপকূলীয় অঞ্চল থেকে দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে দাঁড়কাকের সংখ্যা কমছে আশঙ্কাজনকভাবে। গত কয়েক বছর ধরে বরিশাল-পটুয়াখালী অঞ্চলে শীত মৌসুম এলেই ‘এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা’ নামের এক ধরনের সংক্রামক ব্যাধি ছড়িতে পড়তে দেখা যাচ্ছে। আর এতে মারা যাচ্ছে হাজার হাজার দাঁড়কাক। আবহমান কাল থেকে উপকূলীয় অঞ্চলের গাঁ গ্রামের অধিকাংশ বাড়ির উঠোনে গৃহস্থরা নানাজাতের ফলমূল ও শাকসবজির আবাদ করে আসছে। এ সব ফলমূলের গাছে দল বেঁধে মৌটুসি, টুনটুনি কিংবা বুলবুলির মতো ছোট পাখিরা চিৎকার চেচামেচি করেই দিন কাটাতো। কিন্তু এখন সে সব গাছ আছে। কিন্তু নেই ছোট পাখিরা। এক সময়ে উপকূল ভাগে ১০-১২ ধরনের মৌটুসি পাখি দেখা যেত। টুনটুনিও ছিল ৩-৪ ধরনের। কিন্তু এখন এর প্রায় কোনোটাই নেই।
ছোট পাখি দোয়েল এবং হাড়িচাচা পাখিরও প্রায় দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। গানের পাখি হিসেবে খ্যাত দোয়েলের বাসও ছিল চড়ুইয়ের মতো ঘরের কার্নিশ বা গাছের ফোকরে। দোয়েল আমাদের জাতীয় পাখি হলেও উপকূলীয় অঞ্চল থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
ইদানীং মাছরাঙা পাখির সংখ্যাও আশঙ্কাজনকহারে কমছে। মাছরাঙা বিলুপ্তির প্রধান কারণ হচ্ছে খালবিল বিশেষ করে ধানের জমিতে ব্যাপকহারে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। সার-কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাবে যেমন দেশীয় প্রজাতির অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তেমনি কীটনাশক আক্রান্ত মাছ খেয়ে মাছরাঙাও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। মাত্র কয়েক বছর আগেও এ অঞ্চলে কমলা, পাকড়া, গুড়িয়ালসহ কয়েক প্রজাতির মাছরাঙা দেখা যেত। কিন্তু এখন এর অনেক প্রজাতি নেই। একই কারণে প্রায় বিলুপ্তির পথে এসেছে মাছখেকো আরেক নিরীহ পাখি কানিবক। বকেরও অনেক প্রজাতির বাস ছিল এ অঞ্চলে। কিন্তু কানিবকের মতো অনেক ধরনের বকই এখন দেখা যাচ্ছে না। মাছ শিকারি পানকৌড়িরও তেমন দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। কালো বর্ণের এ পাখিটির সারা বছর ধরে উপকূল অঞ্চলে বিচরণ ছিল। বিশেষ করে নদী-সাগর পাড়ে গেলেই এর দেখা মিলতো। একইভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে গাঙচিল।
ফিঙে পাখি উপকূল থেকে বেশ আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কালেভদ্রে এর দেখা মেলে। শালিকের সংখ্যাও সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কমে আসছে। উপকূলীয় অঞ্চল মানেই এক সময়ে ছিল শালিকের ছড়াছড়ি। ঝুটি শালিক, গোবরে শালিক, ভাত শালিকসহ অনেক ধরনের শালিকের মূল বাস ছিল এ অঞ্চলে। কিন্তু এখন কেবল ভাত শালিকেরই কেবল দেখা মিলছে। বাকিরা প্রায় নিরুদ্দেশ।
সুরেলা কণ্ঠের কোকিল এবং ডাহুকও ক্রমে বিরল প্রজাতি হয়ে উঠছে। অলস দুপুরে ঘুম ভাঙানো যার প্রধান কাজ সেই কালো বর্ণের কোকিল যেন ক্রমে তার সুর হারিয়ে ফেলছে। হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামাঞ্চল থেকে। বাঁশবাগানে শুকনো পাতায় বাসা বানানো পাখি বাঁশকাটাও হারিয়ে যাচ্ছে। সবুজ বর্ণের এ পাখিটি খুবই মনোলোভা। টিয়ার মতোই ছিল এর কদর।
এভাবে একের পর এক হারিয়ে যাচ্ছে উপকূলের পাখি। কখনো গোচরে। আবার কখনো অগোচরে ঘটছে বিলুপ্তি। প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতির শিকার হয়ে পাখি হারাচ্ছে তার খাদ্য ও বাসস্থানসহ বেঁচে থাকার স্বাভাবিক পরিবেশ। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে উপকূলের চিরায়ত রূপ। উপকূলের নিজস্ব জলবায়ুতে বেড়ে ওঠা গাছপালার পরিবর্তে বিদেশী গাছের কারণেও বহু পাখির বিলুপ্তি ঘটছে। বিদেশী গাছে আগের মতো আর পাখি বাসা বাঁধে না। এমন নানা কারণে পাল্টে যাচ্ছে পরিবেশের অনেক কিছুই। সে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে পাখিদের নিজস্ব জগৎ।

এনএন

বাংলাদেশ সময়: ১৪:০৬:৫০   ২১৬৪ বার পঠিত  |      







অন্যান্য থেকে আরও...


কুয়াকাটার পর্যটন ব্যবসায় দাবদাহের প্রভাব, বাতিল হচ্ছে বুকিং
ঈদের ছুটিতে কুয়াকাটা সৈকতে বাড়ছে পর্যটকের ভিড়
ঈদে কুয়াকাটা সৈকতে পর্যটকদের ভীড়
আজ চাঁদ দেখা যায়নি, ঈদ বৃহস্পতিবার
ঈদ-পরবর্তী ছুটিতে পর্যটকদের বরণে প্রস্তুত কুয়াকাটা



আর্কাইভ